এক.
১১ই মার্চ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বহু চড়াই উৎরাই শিবিরকে অতিক্রম করতে হয়েছে। শিবিরের অগ্রযাত্রায় ভীত হয়ে শিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, জুলুম নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর পরিচালনা করা (সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে) হয় এক নারকীয় লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ। সে এক হৃদয়বিদারক মর্মন্তুদ ঘটনা যা কারবালার ইয়াজিদ বাহিনীর নৃসংশতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নবাগত ছাত্র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ ততই বাড়তে থাকে; আর বাতিল শক্তির প্রতিভূ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। শিবির প্রতিষ্ঠার পর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রতি ছাত্রদের সমর্থন বাড়তে দেখে সন্ত্রাসীরা মরিয়া হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে উৎখাত করার জন্য তারা নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ১০ মার্চ প্রচারকার্য পরিচালনার সময় শিবির কর্মীদের ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা করে। এতে কয়েকজন শিবির কর্মী আহত হয়। শিবির তাদের শত উসকানি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মুকাবিলা করে।
দুই.
১১ মার্চ সকাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের আহবানে নবাগত ছাত্র সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। চারদিক থেকে শত শত ছাত্রশিবির কর্মী গগনবিদারী স্লোগান দিতে দিতে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও পার্শ্বের শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, রামদা, বর্শা, ফালা, ছোরা, চাইনিজ কুড়াল ইত্যাদি ধারাল অস্ত্র। শিবিরের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বারবার অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্য উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। শিবির-নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ধৈর্যের সাথেই সংঘর্ষ এড়িয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু তাদের টার্গেট তো ভিন্ন। শিবিরকে স্তব্ধ করে দিতে আজকের অনুষ্ঠানে হামলা চালানো ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তথাকথিত বাম চর্চার কেন্দ্র্রবিন্দু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ ধরনের বড় আয়োজন তারা কোনভাবেই সহ্য করতে পারেনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। এক পর্যায়ে নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চর্তুদিক থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শিবির-কর্মীরা পরিস্থিতি মুকাবিলা করতে সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীরা আবারো সংগঠিত হয়ে হামলা চালায়। দীর্ঘ সময় ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এ সময় শহর থেকে ট্রাক ভর্তি বহিরাগত অস্ত্রধারীরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীদের সাথে যোগ দেয়। শুরু হয় আরো ব্যাপক আক্রমণ। সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় নিরস্ত্র শিবির কর্মীরা দিগবিদিক ছুটাছুটি শুরু করে। আত্মরক্ষার জন্য শিবির কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও কেন্দ্রীয় মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু সেখানেও হায়েনাদের থাবা থেকে রেহাই পায়নি আমাদের ভাইয়েরা। সশস্ত্র দুর্বৃৃত্তরা মসজিদ ও ভবনে আশ্রয় নেয়া নিরীহ শিবির কর্মীদের ওপর তারা পাশবিক কায়দার হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। সন্ত্রাসীদের আঘাতে শহীদ শাব্বির আহম্মেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তার বুকের ওপর পা রেখে তার মাথার মধ্যে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে সমস্ত শরীর। হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদ আব্দুল হামিদ ভাইকে চরম নির্যাতনের সময় তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা একটি ইট মাথার নিচে দিয়ে আর একটি ইট দিয়ে মাথায় আঘাতের পর আঘাত করে তার মাথা ও মুখমণ্ডল থেতলে দেয়; ফলে তার মাথার মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তাক্ত আব্দুল হামিদের মুখমণ্ডল দেখে চেনার কোন উপায় ছিল না। ১২ মার্চ রাত ৯টায় তিনি শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করেন। শহীদ আইয়ুব ভাই শাহাদাত বরণ করেন ১২ মার্চ রাত ১০টা ৪০ মিনিটে। দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর ২৮ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিজ বাড়িতে চিরবিদায় গ্রহণ করেন শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই। তাদের এ নির্মম, নিষ্ঠুর, নৃশংসতা ভাষায় বর্ণনা করার মত নয়। শিবির-কর্মীদের আর্তচিৎকার আর আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলেও কসাইদের পাষাণ হৃদয় এতটুকুও স্পর্শ করতে পারেনি। এ নরপশুরা দীর্ঘ সময় ধরে মৃত্যুর বিভীষিকা সৃষ্টি করলেও মাত্র কিছু দূরত্বে অবস্থানরত পুলিশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও এগিয়ে আসেনি। এমনকি আহত রক্তাক্ত মৃত্যু পথযাত্রী শিবির কর্মীদের উদ্ধার করতেও কোন ভূমিকা পালন করেনি। বারবার অনুরোধের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদার প্রশাসন দীর্ঘ সময় ধরে এ হত্যাযজ্ঞে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি নির্দেশ সেদিন ঘটনাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারতো; হয়ত জীবন দিতে হতো না চারজন নিরপরাধ শিবির কর্মীকে; আহত হতে হতো না শত শত শিবির নেতা-কর্মীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাসহ শিবির-বিরোধী প্রতিটি ঘটনায় বাম ও রামপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক।
তিন.
১১ মার্চে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ওরা শিবিরকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে মরণ কামড় দিয়েছিল কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাদের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়েছে। সময়ের ধারবাহিকতায় বাম ও রামপন্থীদেরকে মাইক্রোসকোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। তারাই তাদের ষড়যন্ত্রের পাতানো ফাঁদে আটকে পড়ে। ওরা আমাদের উৎখাত করতে পারেনি বরং শহীদের রক্ত মতিহারের সবুজ চত্বরকে করেছে উর্বর, শহীদদের সাথীদের করেছে উজ্জীবিত। মতিহারে সবুজ চত্বর হয়েছে শিবিরের একক মজবুত ঘাঁটি। হত্যা, জুলুম নির্যাতন ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরো বেগবান করে তা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে। বাতিল যতই চেষ্টা করুক না কেন আল্লাহ তাঁর নূরকে প্রজ্বলিত রাখবেনই, মহান রাব্বুল আলামীনের এ ঘোষণা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
১১ মার্চের শহীদদের রক্ত বৃথা যায়নি। সেদিনের নৃশংসতা, আহতদের আহাজারি আর আর্ত চিৎকার এবং আহত-শহীদের রক্ত প্রতিটি শিবির কর্মীর প্রাণে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। শিবির কর্মীরা ভাই হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়েনি। তারা শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে। তারা শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে প্রয়োজনে নিজেদের জীবনকেও অকাতরে বিলিয়ে দেবার দীপ্ত শপথ গ্রহণ করেছে।
সেদিন সদম্ভে শিবিরের সাংগঠনিক তৎপরতা তারা নিষিদ্ধ করেছিল। শিবির নেতৃবৃন্দ এতে ভড়কে যাননি। সংগঠনকে আরো মজবুত করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নির্যাতিত নিপীড়িত ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে পাষণ্ডদের নৃশংসতা তুলে ধরে। তুলে ধরে শিবির কর্মীদের প্রকৃত অপরাধ ‘তারা আল্লাহর পথে কাজ করে। তুলে ধরে মুসলমানদের বাংলাদেশে ইসলামের জন্য কাজ করার ব্যাপারে সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রেক্ষাপট। সংগঠনের আদর্শিক সৌন্দর্য ও নিজেদের উন্নত আচরণ, উন্নত নৈতিক চরিত্রের মাধ্যমে শিবির পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের হৃদয়ে নিজেদের অবস্থান করে নেয়; রচিত হয় শিবিরের প্রাথমিক শক্তিশালী ভিত্তি। ধীরে ধীরে এলাকার মানুষের কাছে সন্ত্রাসীরা ঘৃণিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিবির উৎখাত করার জন্য বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কোন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে শিবির বিচলিত হয়ে যায়নি; আপস করেনি। বাতিলে চক্রান্তের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে কখনও শিবির পিছপাও হয়নি।
শিবির কর্মীরা ইচ্ছা করলে ৪ শহীদের খুনিদের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু তা করেনি তারা। অথচ এ ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের সীমাহীন বাড়াবাড়ি যে কাউকে ধৈর্যহীন আর বিক্ষুব্ধ না করে পারে না। ৪টি তরতাজা প্রাণ হত্যা করার পর হত্যাকারীদের পক্ষ থেকে মজলুমদের তৎপরতা নিষিদ্ধ করার যে ঘোষণা- তা স্বাভাবিকভাবে নেয়ার কথা নয়। কিন্তু চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে শিবির। শিবির কর্মীরা মজলুমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেছেন এ ক্যাম্পাসে। আর আল্লাহ যদি কারো সাহায্য করেন তাহলে আর কারো সাহায্যের দরকার হয় না।
মতিহারের সবুজ চত্বর ৪ জন শহীদের খুনকে ধারণ করার যে দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছে তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে, এখানকার জনশক্তিকে করেছে মহিমান্বিত ও গৌরবের উত্তরাধিকারী। বাংলাদেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়দীপ্ত কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রথম ৪ শহীদ হচ্ছেন ১১ মার্চের শহীদ শাব্বির, হামিদ, আইয়ূব ও জব্বার। এভাবেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরকর্মীরা ত্যাগ ও কুরবানির যে কঠিন নজরানা পেশ করেছে তা দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার হৃদয়কে কেড়ে নিয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা এ কাফেলার দিকে ধাবিত হয়েছে। সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে শাহাদাতের যে সূচনা হয়েছিল শাহাদাতের সেই মিছিল বড় হয়েই চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৩১(বর্তমান ২৩৪) জন নেতাকর্মী শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছেন। শহীদদের মিছিল যতই বড় হয়েছে লক্ষ তরুণ প্রাণ শিবিরের আহবানে ততই সাড়া দিয়েছে। শিবির আজ বাংলাদেশের শক্তিশালী ও সুসংগঠিত একটি অপ্রতিরোধ্য কাফেলার নাম। আলহামদুল্লিাহ!
এ নির্মম ঘটনায় বাম ও রামপন্থীদের উগ্রতা, নৃশংসতা আর বর্বরতা জনসমক্ষে আরো বেশি দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। একটি সংগঠনকে আদর্শিকভাবে মুকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে পেশিশক্তি প্রয়োগে তারা কতটুক নির্মম হতে পারে, ১১ মার্চের হত্যাযজ্ঞ তারই স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৮৫% মানুষের মূল্যবোধের পক্ষের একটি শক্তিকে উৎখাত করার এ প্রবণতা ভিন্নমতকে দলিত মথিত করার, গলা টিপে ধরার, বাক স্বাধীনতাকে হরণ করার ‘সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ’ নিষ্ঠুরতাকেই জানান দেয়।
সেদিন মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য যদি কাউকে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করতে হয় তাহলে দায়িত্ব পালনে অবহেলা আর ব্যর্থতার দায়ে কুখ্যাত ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদা ও প্রক্টর মনিরুজ্জামানকেই চিহ্নিত করতে হবে। সেদিন শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে ভিসিকে অনুরোধ করা হয়েছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে হস্তক্ষেপের অনুমতি দিতে, কিন্তু তিনি দেননি। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে গেটে অনুমতি প্রার্থনা করলেও পুলিশকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেননি তিনি। উল্টো দম্ভোক্তি করেছিলেন। কিন্তু তিনি কি চিরদিন ক্ষমতা আটকে রাখতে পেরেছেন? অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে দালালি আর তোষামোদ করে এবং সন্ত্রাসীদের কাছে মাথা নত করে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা যায় না; পাপ বাপকেও ছেড়ে দেয় না। তৎকালীন কুখ্যাত ভাইস চ্যান্সেলর মুসলিম হুদা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এ খুনের নামমাত্র বিচার হয়। সন্ত্রাসীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় কয়েকজনের। স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যাতে দানা বেঁধে উঠতে না পারে সেজন্য চলছিল ষড়যন্ত্র। আর তারই অংশ হিসেবে বামপন্থীদের সাথে আঁতাত করে এরশাদ খুনিদের রক্ষা করে মানবতার বিরুদ্ধে আরো একটি চরম অপরাধ করে বসে। কিন্তু এরশাদও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। শাহাদাতের রক্তধোয়া চেতনায় এ দেশের মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল। স্বৈরসাশক এরশাদের করুণ পরিণতি সকলে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে।
খুনিদেরকে হয়তো ক্ষমতার দাপটে মাফ করে দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা কি প্রকৃত পক্ষে নিরাপদ? না তা নয়। তারা অনেকেই হয়তা আজ প্রতিষ্ঠিত কিন্তু সেটাই কি সবকিছু? না তাও নয়। যতদিন তারা বেঁচে থাকবে এ জঘন্য অপরাধ তাদেরকে তাড়া করে ফিরবে, ফিরছে। একজন মানুষকে হত্যা করাতো মানবতাকে হত্যা করার শামিল। তারা নৃশংসভাবে ৪ জনকে হত্যা করেছে, দুনিয়াতেই কেউ হয়ত শাস্তি পাচ্ছে, কেউ হয়ত পরে পাবে। এ কত বড় অপরাধ তা অনুধাবন দুনিয়াতে করতে না পারলেও পরকালে মহান রাব্বুল আলামিন অবশ্যই তার বিচার করবেন এবং যথার্থ শাস্তি দেবেন। যেখান থেকে পালানোর কোন সুযোগ করো থাকবে না।
যারা শহীদ কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত তাদের শাহাদাত কবুলিয়াতের জন্য আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করা হবে; আলোচনা সভা হবে, স্মরণ করবে সবাই। তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নেবে; শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হবে-আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত হবে। শহীদরা চিরঞ্জীব। তারা হারিয়ে যাবে না কিন্তু খুনি ছানা, রানা, আজাদ গং ঘৃণিত হতে থাকবে, অভিশপ্ত হতে থাকবে চিরদিন। তারা হারিয়ে যাবে সময়ের অতল গহবরে। মানুষ, প্রকৃতি, আল্লাহর সৃষ্টি জগৎ তাদের বিরুদ্ধে লানত করবে।
চার.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেভেন মার্ডারের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে যে হত্যার রাজনীতির সূচনা, ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, তার ধারাবাহিকতা আজও চলে আসছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ, বিবৃতি, বিক্ষোভ, হরতাল, ধর্মঘট হয়েছে। সাময়িকভাবে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপও কোন কোন ক্ষেত্রে নেয়া হয়েছে। কিন্তু চলমান ছাত্ররাজনীতি সন্ত্রাসের এ ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। কখনও কখনও ছাত্ররাজনীতির এ ধারার কারণে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের স্লোগান উঠেছে, পক্ষে-বিপক্ষে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয়েছে, সভা সমাবেশ হয়েছে। সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও নেয়া হয়েছে অনেকবার কিন্তু ফলাফল অনেক ক্ষেত্রে সাময়িক, অনেক সময় ফলাফল প্রায় শূন্যই। এর পরও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ১১ মার্চের ঘটনার জন্য ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ষড়যন্ত্রকারীরাই দায়ী তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার, শিক্ষকদের দলীয় নোংরা রাজনীতি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হীন মানসিকতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার অভাব, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের অভাব; আইন যথাযথ প্রয়োগের অভাব, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি-বিশেষ করে আদর্শকে আদর্শ দিয়ে, যুক্তি দিয়ে মুকাবিলার পরিবর্তে পেশিশক্তি দিয়ে মুকাবিলার মানসিকতাও দায়ী। এ জন্য প্রচলিত আদর্শহীন শিক্ষাব্যবস্থাও কম দায়ী নয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের মানসিক চেতনাকে জাগ্রত করার পরিবর্তে পাশবিকতাকে বিকশিত করছে। ফলে আগামীদিনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আজকের ছাত্রসমাজ মানুষের প্রতি, সৃষ্টির প্রতি, তাদের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে না।
শুধু ১১ মার্চ নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত পূর্বাপর সমস্ত ঘটনার যথাযথ তদন্ত করা হলে প্রায় একই কারণ বেরিয়ে আসবে। এমতাবস্থায় সরকারকে আরো শক্ত পদক্ষেপ নেয়া উচিত যাতে আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়। আর কাউকে ভাই হারা, ছেলে হারা, সন্তান হারা হতে না হয়। আর আমাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন কোন পশুশক্তির উন্মত্ততায় অস্থিতিশীল হয়ে বন্ধ না হয়। একেকটি অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে এককেটি পদক্ষেপ এমনভাবে নেয়া উচিত যাতে করে নতুন ভাবে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনভাবেই না ঘটে। অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও এখনও আমাদের দেশের বড় সমস্যা সন্ত্রাস এটি ভাবতেই লজ্জা হয়। তাই আর দেরি নয়। সময়ের সাহসী পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। সন্ত্রাসের এ নগ্ন নখরকে উপড়ে ফেলতে হবে সমাজ থেকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, দেশ থেকে।
লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির